১০ কেজি ওজনের রহস্যময় ফুল রাফ্লেশিয়া

সংগৃহীত ছবি

 

ফিচার ডেস্ক :প্রকৃতি এক রহস্যময় শিল্পী। সে কখনো প্রাণবন্ত রঙে এঁকে দেয় কৃষ্ণচূড়া কিংবা বকুলের সৌন্দর্য, আবার কখনো আবরণ সরিয়ে দেখায় এমন এক বাস্তবতা, যা বিস্ময়ে স্থবির করে দেয় মানববুদ্ধিকে। তেমনই এক প্রকৃতির বিস্ময় রাফ্লেশিয়া। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একক ফুলটির নাম উচ্চারণেই যেন এক ধরনের সৌন্দর্য ও গূঢ়তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

রাফ্লেশিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম র‌্যাফ্লেশিয়া আরনোলডি। এটি প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮১৮ সালে, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের গহীন বনে, ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ জোসেফ আর্নল্ড এবং অভিযাত্রী স্যার স্ট্যামফোর্ড র‌্যাফেলস এর অনুসন্ধানে। দুজনের নাম সংযুক্ত করেই এই ফুলের নামকরণ করা হয়। মূলত মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বৃষ্টিবনে এটি জন্মায়। তবে তার জন্ম এক অলৌকিক যন্ত্রণার মতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা, নির্দিষ্ট পুষ্টি নির্ভরতা এবং নীরবতার মাঝে এর ফুল ফোটা।

 

রাফ্লেশিয়া ফুলের ব্যাস ৩ ফুট (প্রায় ১ মিটার) পর্যন্ত হতে পারে এবং ওজন হতে পারে ১০ কেজিরও বেশি। এই ফুলের আরেকটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হলো এটি কোনো পাতা, মূল বা কাণ্ড ছাড়া জন্মে। এটি একটি সম্পূর্ণ পরজীবী উদ্ভিদ, যার জীবনচক্র নির্ভর করে টেট্রাটিগমা নামক একধরনের লতা উদ্ভিদের ওপর। রাফ্লেশিয়া সেই গাছের শরীরের ভেতরে ঢুকে যায়, নীরবে পুষ্টি শুষে নেয় এবং অবশেষে, বহুদিন পর যখন সব শর্ত মিলে যায়, তখনই বাইরে ফোটে তার দৈত্যাকৃতি, রক্তিম ফুলটি।

রাফ্লেশিয়ার সবচেয়ে আলোচিত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর গন্ধ। এটি পঁচা মাংসের মতো একধরনের তীব্র দুর্গন্ধ ছড়ায়। এই গন্ধ মাছি ও অন্যান্য পতঙ্গকে আকৃষ্ট করে, যারা ফুলের পরাগায়ণে ভূমিকা রাখে। পরাগায়ণ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল এবং সফল ফুল ফোটার সম্ভাবনা খুবই কম, যা একে আরও বিরল করে তোলে।

 

রাফ্লেশিয়া কোনো সাধারণ বাগান বা চাষের উপযোগী ফুল নয়। এটি শুধু নির্দিষ্ট প্রজাতির গাছ ও নির্দিষ্ট পরিবেশে জন্মায়। ফলে এর চাষ বা আবাদ প্রায় অসম্ভব। বন উজাড়, আবাসস্থল ধ্বংস ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ফুল বর্তমানে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই রাফ্লেশিয়াকে সংরক্ষণের জন্য নানা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজ করছে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার কিছু সংরক্ষিত বনে এই ফুল পর্যবেক্ষণের সুযোগ রয়েছে, তবে সেগুলোও অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত।

 

রাফ্লেশিয়া ফুলের কোনো ওষুধি বা সরাসরি ব্যবহার তেমন দেখা যায় না। তবে স্থানীয় কিছু জনগোষ্ঠী এর কিছু অংশকে ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসায় ব্যবহার করে থাকে। তবে এগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দুর্বল ও বিতর্কিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, রাফ্লেশিয়া শুধুমাত্র জীববৈচিত্র্যের নিদর্শন ও পরিবেশগত ভারসাম্যের পরিচায়ক হিসেবে বিবেচিত। কিছু সংস্কৃতিতে এই ফুলকে অশুভ বা অলৌকিক শক্তির প্রতীক বলেও ধরা হয়।

রাফ্লেশিয়া যেন প্রকৃতির এক বিপরীতমুখী প্রেম। একদিকে তার অবাক করা রূপ, অন্যদিকে তার গন্ধময় বিভীষিকা। কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইন লিখেছেন, ‘আমাদের আর কখনো দেখা হবে না।/যেখানে শেষ দেখা, সেখানে পড়ে থাকবে শিউলী ফুল, অথচ গন্ধ ছড়াবে রাফ্লেশিয়া।’ রাফ্লেশিয়া সুন্দর অথচ ভয়ংকর, বিরল অথচ প্রাকৃতিক। এ যেন প্রকৃতির অভিশপ্ত প্রেমিকা, যার সৌন্দর্য মুগ্ধ করে, কিন্তু ঘ্রাণ বিদগ্ধ করে। রাফ্লেশিয়া শুধু একটি ফুল নয় এটি প্রকৃতির রহস্য, বৈচিত্র্য এবং জটিলতার প্রতীক।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রদূত আনসারীর সাক্ষাৎ

» সারা দেশ অচল করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল

» জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাৎবার্ষিকীতে ৮ দিনের কর্মসূচি বিএনপির

» বিগত ১৬ বছরে দুদু ভাই একটা গণপ্রস্রাব কর্মসূচির ডাক দিলেই পারতো !: সারজিস

» বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিলেন ইশরাকের সমর্থকরা

» দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক প্রধান উপদেষ্টার

» উপদেষ্টাদের জন্য ২৫ গাড়ি কেনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল সরকার

» আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে লাভ নেই: আসিফ মাহমুদ

» জামালপুরের মেলান্দহে গাঁজার গাছসহ একজন আটক

» বর্ষসেরা এসএমই ব্যাংকার অ্যাওয়ার্ড জিতলেন ব্র্যাক ব্যাংকের সৈয়দ আব্দুল মোমেন

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

১০ কেজি ওজনের রহস্যময় ফুল রাফ্লেশিয়া

সংগৃহীত ছবি

 

ফিচার ডেস্ক :প্রকৃতি এক রহস্যময় শিল্পী। সে কখনো প্রাণবন্ত রঙে এঁকে দেয় কৃষ্ণচূড়া কিংবা বকুলের সৌন্দর্য, আবার কখনো আবরণ সরিয়ে দেখায় এমন এক বাস্তবতা, যা বিস্ময়ে স্থবির করে দেয় মানববুদ্ধিকে। তেমনই এক প্রকৃতির বিস্ময় রাফ্লেশিয়া। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একক ফুলটির নাম উচ্চারণেই যেন এক ধরনের সৌন্দর্য ও গূঢ়তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

রাফ্লেশিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম র‌্যাফ্লেশিয়া আরনোলডি। এটি প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮১৮ সালে, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের গহীন বনে, ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ জোসেফ আর্নল্ড এবং অভিযাত্রী স্যার স্ট্যামফোর্ড র‌্যাফেলস এর অনুসন্ধানে। দুজনের নাম সংযুক্ত করেই এই ফুলের নামকরণ করা হয়। মূলত মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বৃষ্টিবনে এটি জন্মায়। তবে তার জন্ম এক অলৌকিক যন্ত্রণার মতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা, নির্দিষ্ট পুষ্টি নির্ভরতা এবং নীরবতার মাঝে এর ফুল ফোটা।

 

রাফ্লেশিয়া ফুলের ব্যাস ৩ ফুট (প্রায় ১ মিটার) পর্যন্ত হতে পারে এবং ওজন হতে পারে ১০ কেজিরও বেশি। এই ফুলের আরেকটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হলো এটি কোনো পাতা, মূল বা কাণ্ড ছাড়া জন্মে। এটি একটি সম্পূর্ণ পরজীবী উদ্ভিদ, যার জীবনচক্র নির্ভর করে টেট্রাটিগমা নামক একধরনের লতা উদ্ভিদের ওপর। রাফ্লেশিয়া সেই গাছের শরীরের ভেতরে ঢুকে যায়, নীরবে পুষ্টি শুষে নেয় এবং অবশেষে, বহুদিন পর যখন সব শর্ত মিলে যায়, তখনই বাইরে ফোটে তার দৈত্যাকৃতি, রক্তিম ফুলটি।

রাফ্লেশিয়ার সবচেয়ে আলোচিত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর গন্ধ। এটি পঁচা মাংসের মতো একধরনের তীব্র দুর্গন্ধ ছড়ায়। এই গন্ধ মাছি ও অন্যান্য পতঙ্গকে আকৃষ্ট করে, যারা ফুলের পরাগায়ণে ভূমিকা রাখে। পরাগায়ণ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল এবং সফল ফুল ফোটার সম্ভাবনা খুবই কম, যা একে আরও বিরল করে তোলে।

 

রাফ্লেশিয়া কোনো সাধারণ বাগান বা চাষের উপযোগী ফুল নয়। এটি শুধু নির্দিষ্ট প্রজাতির গাছ ও নির্দিষ্ট পরিবেশে জন্মায়। ফলে এর চাষ বা আবাদ প্রায় অসম্ভব। বন উজাড়, আবাসস্থল ধ্বংস ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ফুল বর্তমানে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই রাফ্লেশিয়াকে সংরক্ষণের জন্য নানা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজ করছে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার কিছু সংরক্ষিত বনে এই ফুল পর্যবেক্ষণের সুযোগ রয়েছে, তবে সেগুলোও অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত।

 

রাফ্লেশিয়া ফুলের কোনো ওষুধি বা সরাসরি ব্যবহার তেমন দেখা যায় না। তবে স্থানীয় কিছু জনগোষ্ঠী এর কিছু অংশকে ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসায় ব্যবহার করে থাকে। তবে এগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দুর্বল ও বিতর্কিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, রাফ্লেশিয়া শুধুমাত্র জীববৈচিত্র্যের নিদর্শন ও পরিবেশগত ভারসাম্যের পরিচায়ক হিসেবে বিবেচিত। কিছু সংস্কৃতিতে এই ফুলকে অশুভ বা অলৌকিক শক্তির প্রতীক বলেও ধরা হয়।

রাফ্লেশিয়া যেন প্রকৃতির এক বিপরীতমুখী প্রেম। একদিকে তার অবাক করা রূপ, অন্যদিকে তার গন্ধময় বিভীষিকা। কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইন লিখেছেন, ‘আমাদের আর কখনো দেখা হবে না।/যেখানে শেষ দেখা, সেখানে পড়ে থাকবে শিউলী ফুল, অথচ গন্ধ ছড়াবে রাফ্লেশিয়া।’ রাফ্লেশিয়া সুন্দর অথচ ভয়ংকর, বিরল অথচ প্রাকৃতিক। এ যেন প্রকৃতির অভিশপ্ত প্রেমিকা, যার সৌন্দর্য মুগ্ধ করে, কিন্তু ঘ্রাণ বিদগ্ধ করে। রাফ্লেশিয়া শুধু একটি ফুল নয় এটি প্রকৃতির রহস্য, বৈচিত্র্য এবং জটিলতার প্রতীক।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com